আমাদের দেশে , পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে যানবাহন, ব্রিটিশরা আসার অনেক আগে থেকে প্রচলিত I দেশ ব্রিটিশ উপনিবেশ হওয়ার পর, রাস্তা ও যানবাহন চলাচল কে নিয়মাবদ্ধ করার একটা উদ্যোগ নেওয়া হয় I এর জন্য প্রয়োজন হয় রাস্তা ঘাটে প্রযোজ্য একটা আচরণ বিধি এবং সেই সংশ্লিষ্ট নানা রকম নিয়ম, আইন-কানুন ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থ্যা I এই উদ্দেশ্য পূরণ করতে ১৯১৪ সালে তৈরী হয় প্রথম ভারতীয় যানবাহন আইন I এই আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাস্তায় যানবাহন চলাচলের উপর একটা সহজ এবং সঠিক প্রশাসন বজায় রাখা I
"ভারতীয় যানবাহন আইন , ১৯১৪ " ছিল একটি কেন্দ্রীয় আইন যেটি সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে প্রযোজ্য ছিল I এই আইনের ১৮ টি ভাগ ছিল এবং স্থানীয় সরকার দের দায়িত্ব ছিল যানবাহন ও চালক দের নথিভুক্ত ( রেজিস্ট্রি) করা ও আইন ব্যবস্থ্যা সঠিক ভাবে পরিচালনা করা I পরে এই আইন বদলে হয় "যানবাহন আইন ১৯৩৯" যেটি কার্যকর হয় ১৯৪০ এ I
এরপর প্রযুক্তির প্রয়োগ বৃদ্ধি ও দেশের সামগ্রিক উন্নতির ফলে প্রয়োজন হয় নিয়মাবলীতে পরিবর্তন আনা এবং তারই ফলস্বরূপ লাঘব হয় সর্বশেষ যানবাহন আইন ১৯৮৮ সালে I
২০১৭ সালে এই আইনে আরও কিছু পরিবর্তনের প্রস্তাব লোকসভায় পাশ হয়ে গেলেও আটকে যায় রাজ্য সভায় I
"কনসিউমার ভয়েস" নামক একটি নীতিনির্ধারণ ও অভিযোগ সমাধানকারী সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী ৯৬% মনে করেন যে এই বিল টি পাশ হলে ইউ.এন আদেশপত্র অনুযায়ী ২০২০ র মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা ৫০% অবধি কম করা সম্ভব হবে I
ভারতবর্ষে সড়ক দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যুর সংখ্যা এই মুহূর্তে বার্ষিক ১.৬ লক্ষ - পৃথিবীর তালিকার উচ্চস্থানে অন্যতম I এই সংখ্যা কে কমানোর জন্য ৯৭% মনে করেন যে এই বিল টি রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে সবার সমর্থন করা উচিত I
এই বিলটি তে কিছু নতুন ভাগ আছে আর কিছু বর্তমান ভাগে পরিবর্তন আছে I
পুরোনো এবং নতুন যানবাহন আইনের পার্থক্য:
১.নতুন আইন অনুযায়ী চালকের লাইসেন্স ও যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন করানোর জন্য আঁধার কার্ড বাধ্যতামূলক প্রয়োজন হবে I
২.যে সব ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার পর চালক উধাও হয়ে যায় এবং দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির মৃত্যু হয়, এখন সেই সব ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ হলো মাত্র ২৫০০০ টাকা I নতুন আইনে মৃতের পরিবারের জন্য , এই ক্ষতিপূরণের মাত্রা বাড়িয়ে Rs.২ লক্ষ বা তার বেশী সুপারিশ করা হয়েছে I
৩. দুর্ঘটনার কারণ যখন অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক , তখন দায়ী হবে হয় চালকের বাবা-মা অথবা গাড়ির মালিক যদি না তারা প্রমাণ করতে পারেন যে তারা এই অপরাধ সম্মন্ধে কিছু জানতেন না বা তারা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন I যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দেওয়া হবে এবং ওই অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকের উপর শিশু বিচার আইন অনুযায়ী বিচার করা হবে I
৪.দুর্ঘটনার সময় রাস্তায় উপস্থিত যে ব্যক্তি/ব্যক্তিরা সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন ( Good Samaritans ) তাদের কোনোরকম আইনী দায়বদ্ধতা থাকবে না I তারা চাইলে নিজেদের পরিচয় পুলিশ বা ডাক্তার/হাসপাতালে নাও জানাতে পারেন I
৫. মদ খেয়ে গাড়ি চালানোর ন্যূনতম জরিমানা Rs.২০০০ থেকে Rs.১০০০০ করা হয়েছে I
৬.দায়িত্বজ্ঞানহীন তীব্র গতিতে গাড়ি চালানোর জড়িমানা Rs.১০০০ থেকে Rs.৫০০০ করা হয়েছে I
৭.লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর ন্যূনতম জড়িমানা হবে বর্তমান Rs.৫০০র জায়গায় Rs.৫০০০ টাকা I
৮.গতিসীমার উর্ধে গাড়ি চালানোর জড়িমানা Rs.৪০০ থেকে বেড়ে হবে Rs.১০০০-২০০০ I
৯.সিট বেল্ট না পড়ার জড়িমানা বর্তমান Rs.১০০ থেকে বেড়ে হবে Rs.১০০০ I
১০. গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বলার জড়িমানা বর্তমান Rs.১০০০ থেকে বেড়ে হবে Rs.৫০০০ I
১১. একটি যানবাহন দুর্ঘটনা তহবিল তৈরী করা হবে যার থেকে ভারতবর্ষের সব রাস্তার ব্যবকারীরা কিছু রকমের দুর্ঘটনার জন্য বাধ্যতামূলক বীমা পাবেন I
১২. সব যানবাহনকে এমন ভাবে পরিবর্তন করতে হবে যাতে যাদের বিশেষ প্রয়োজন আছে তারাও সহজেই ব্যবহার করতে পারেন I
১৩. যে সব দুর্ঘটনা রাস্তার নকশা/নির্মাণের ত্রুটি বা অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের কারণে হবে, তার জন্য দায়ী হবেন ঠিকাদার, পরামর্শদাতা এবং নাগরিক সংস্থা I
১৪. দুর্ঘটনার ৬ মাসের মধ্যে ক্ষতিপূরণের দাবী জানাতে হবে ক্লেইমস ট্রাইবুনালে (Claims Tribunal )I
১৫. তৃতীয় পক্ষ বীমার সর্বোচ্চ সীমা সরিয়ে দেওয়া হবে I ২০১৬ র বিলে এই সীমা ছিল মৃত্যুর ক্ষেত্রে Rs.১০ লক্ষ আর মর্মান্তিক আঘাতের জন্য Rs.৫ লক্ষ I
১৬. দেখা যায় যে একবার চালানোর লাইসেন্স পেয়ে গেলে রিনিউ করার কথা অনেকে ভুলে যান i আর এর জন্য ১ মাস সময় খুব কম বলে এই সময় সীমাকে বাড়িয়ে লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১ বছর আগে থেকে ১ বছর পর অবধি করা হবে I
১৭. গাড়ির ইঞ্জিন এবং অন্যান্য যন্ত্রাংশ সঠিক গুণমানের না হলে নানা রকমের দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে I আর থাকে পরিবেশ ক্ষয় হওয়ার সম্ভাবনা I এই আইন অনুযায়ী সরকার সেরকম সব যানবাহন কে প্রত্যাহার করতে পারে যেগুলোতে সঠিক মানের ইঞ্জিন বা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয় নি এবং এই সব গাড়ির উদ্পাদক কোম্পানি দের উপর ৫০০ কোটি টাকা অবধি জড়িমানা হতে পারে I
এম.ভি.এ. ১৯৮৮ ও এম.ভি.সংশোধন ২০১৭ র পার্থক্য ছোট করে :
বিষয়
|
এম.ভি.এ. ১৯৮৮
|
এম.ভি.এ. ২০১৭
|
যানবাহন রেজিস্ট্রেশন ও চালকের লাইসেন্সের জন্য আঁধার কার্ড বাধ্যতামূলক
|
না
|
হ্যা
|
মৃত্যু ও চালক পলাতক ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ
|
Rs.২৫০০০
|
Rs. ২০০০০০
|
মদ খেয়ে চালানোর ন্যূনতম জড়িমানা
|
Rs.২০০০
|
Rs. ১০০০০
|
দায়িত্বজ্ঞানহীন তীব্র গতিতে গাড়ি চালানোর জড়িমানা
|
Rs.১০০০
|
Rs. ৫০০০
|
লাইসেন্স ছাড়া চালানোর ন্যূনতম জড়িমানা
|
Rs.৫০০
|
Rs. ৫০০০
|
গতিসীমার উর্ধে চালানোর ন্যূনতম জড়িমানা
|
Rs.৪০০
|
Rs. ১০০০
|
যাদের বিশেষ প্রয়োজন আছে তাদের জন্য গাড়ি তে পরিবর্তন আনা
|
না
|
হ্যা
|
ড্রাইভিং লাইসেন্স রিনিউ করার সময়সীমা
|
১ মাস
|
১ বছর
|
প্রয়োজনীয় মানের নীচে ইঞ্জিন বা যন্ত্রাংশ ব্যবহারের জন্য উদ্পাদকের উপর ন্যূনতম জড়িমানা
|
সংজ্ঞায়িত না
|
Rs. ৫০০ কোটি
|
যেমন সহজেই দেখা যাচ্ছে যে বর্তমান আইন এবং পরিবর্তন গুলির মধ্যে প্রচুর পার্থক্য I লোকসভায় প্রস্তাবিত পরিবর্র্তন গুলো পাশ হয়ে গেছে কিন্তু রাজ্যসভায় পাশ হয় নি I আশা করা যায় যে এই বিল পাশ হলে যে সব পরিবর্তন আসবে তাতে রাস্তায় দুর্ঘটনার ফলে মৃত্যুর সংখ্যা নিশ্চই কমবে I
No comments:
Post a Comment